DEHLIJ

জয়ন্ত ঘোষাল

এত রক্ত কেন






হিংসা নিয়ে যে বিষয়টা আমার মনস্তত্ত্বে প্রথম ঝড় তুলেছিল সেই ছোট্ট বইটির রচয়িতা ছিলেন  হার্বার্ট আফতেকর । কলেজ জীবনে তাঁর  'ডেমোক্রেসি এন্ড ভায়োলেন্স'(democracy and violence) শীর্ষক বইটি পড়ে ভাবনার চারা গাছে অনেক জল ঢেলে ছিলাম। তিনি  বলেছিলেন যে হিংসা যখন উপায় '' (means) তখন সেটার মধ্যে বীভৎসতা থাকতে পারে। সেটা মানব জীবনের কাছে নেতিবাচক মনে হতে পারে।


অনেক সময় 'মিনস'টা হিংসাত্মক হলেও 'এন্ড' (end) লক্ষ্যটা মানবকল্যাণের হতে পারে। এই 'মিনস' এবং 'এন্ড' এর জে  তত্ত্ব  সেটা গান্ধীজী মানতেন না। মূলত কার্ল    মার্কসের আলোচনা থেকে আহৃত এটা লেনিনিও  তত্ত্ব। যদিও কার্ল মার্কস নিজে সরাসরি হিংসাত্মক বিপ্লবের কথা বলেছেন এমনটা কিন্তু কোন লেখায় সরাসরি পাওয়া যায় না।  সশস্ত্র রক্ত ঝরানো বিপ্লবের কথা না বললেও সমাজ পরিবর্তন এবং বিপ্লবের কথা   নিশ্চয়ই বলেছিলেন। এখন এই ভায়োলেন্ট রেভলিউশন(violent revolution) অর্থাৎ সহিংস বিপ্লব যেটা পরবর্তীকালে বিভিন্ন জায়গায় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে  । নতুন করে এটার একটা ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে সেটাও আমরা দেখলাম। গান্ধীজী কিন্তু এই হিংসার পথটাকেই বর্জন করতে বলেছিলেন। তিনি নন-ভায়োলেন্স শব্দটার থেকেও বেশী জোর দিয়েছিলেন অহিংসা নামক সংস্কৃত শব্দ টার ওপর । তাঁর অহিংসা  শব্দটি এসেছে ' আহমিসা'  সংস্কৃত শব্দটা থেকে। অহিংসা আর non-violence এই দুটো শব্দের মধ্যে একটা ব্যঞ্জনা গত  পার্থক্য আছে ।সেটা হল non-violence, এটার মধ্যে একটা non আছে, যেটা নেতিবাচক । কিন্তু অহিংসা শব্দটির মধ্যে 'অ' থাকলেও 'ন' নেই । অর্থাৎ যেমন নিরীশ্বরবাদী আর অনিশ্বরবাদী । হিন্দু দর্শনে কিন্তু এই দুই ধরনের school of thought  আছে। যে দুটো আলাদা। যাইহোক এখন অনিশ্বর আর নিরীশ্বরবাদ এর ফারাক  নিয়ে  আলোচনা করার বিষয়টা আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু নয়। কিন্তু এই যে অহিংসা এবং হিংসা এটা নিয়েও আজ নতুন করে অনেক আলোচনা হচ্ছে।


প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের কন্যা উপেন্দর সিং তিনি পরপর দুটি বই লিখলেন। যেখানে  তিনি দেখিয়েছেন  যে ভারতের সংস্কৃতির মধ্যে কিন্তু হিংসা এবং অহিংসার মধ্যে একটা সংঘাত  ছিল ।তিনি বলতে চাইছেন ,বারবার যদি হিংসা নামক বিষয়টা ভারতীয় ইতিহাসের বিষয় না হয়ে থাকে তাহলে রামায়ণ থেকে মহাভারত সমস্ত পুরান এমনকি শ্রীকৃষ্ণ এর ভগবত গীতা তে পর্যন্ত যে যুদ্ধের বর্ণনা সেখানে কিন্তু বারবার হিংসা এসেছে। সুতরাং হিংসা হীন ছিল  ভারত এ কথা কিন্তু সত্যের অপলাপ। কিন্তু হিংসা থেকে অহিংসা তে পৌঁছনোর একটা অভিমুখ সেটা  বারবার উচ্চারিত হয়েছে।  উপনিষদে কিন্তু এই হিংসা কে পরিত্যাগ করে।  গীতাতে কিন্তু এই ইন্দ্রিয় আসক্তি  থেকে বিষয় আসক্তি তে পৌঁছোতে বলেছে ।যেখানে ভালবাসার একটা স্বর্গরাজ্যে মানুষকে পৌঁছতে হবে ।সেটা হতে পারে আদর্শ ,সেটা হতে পারে ইউটোপিয়া অর্থাৎ গান্ধীর রামরাজ্য, অথবা কার্ল মার্কসের কমিউনিস্ট সোসাইটি। যেখানে শ্রেণিসংগ্রাম wither away হয়ে  যাবে বলে তিনি কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো তে আশা প্রকাশ করেছিলেন শেষে এসে। অর্থাৎ কর্পূরের মত উবে যাবে এই শ্রেণীসংগ্রামের সংঘর্ষ। এখন ধর্মের নামে যে হিংসা হচ্ছে সেটা কিন্তু শুধুমাত্র রাজনৈতিক হিংসা নয়। সেটা কিন্তু শুধু হিংসার বিষয় নয়। সেটার মধ্যে আছে সম্প্রদায়গত হিংসা ।অর্থাৎ কে হিন্দু ,কে মুসলিম এবং কে কোন জাতির তার জন্য হিংসা হচ্ছে ।উচ্চবর্ণের সাথে নিম্নবর্ণের হিংসা।এই হিংসা মানে অসহিষ্ণুতা।এই হিংসা মানে exclusivist approach..সেই জায়গাটা থেকে আমাদেরকে সরে আসতে হবে।


অধুনা বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপরে উগ্রপন্থী, মৌলবাদী মুসলিমদের আক্রমণ হয়েছে ।আবার ত্রিপুরাতে মসজিদ ভাঙার ঘটনা ও কাগজে প্রকাশিত হয়েছে। যদিও ভারত সরকার সেটা অস্বীকার করেছে। তারা বলেছে যে, এটা সত্য নয় এটা একটা অপপ্রচার। আসলে কোনটা সত্য কোনটা 'ফেক ' নিউজ সেইসব বিতর্কে আমি যাচ্ছি না।কিন্তু একথা সত্য যে দুটো সম্প্রদায়ের মধ্যেই উগ্রপন্থা আছে।  এই উগ্রপন্থায় কিন্তু কখনোই কোনো পক্ষেরই মৌলবাদ ভালো নয়। হিন্দু এবং মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা একে অন্যের পরিপূরক

অর্থাৎ 'হিন্দু sovereignism' আর মুসলিম separatism' কোনটা কার্য আর কোনটা কারণ এই causality  এর তত্ত্ব খুঁজতে গিয়ে হিংসা ক্রমশ বাড়তেই থাকে। কিছু তাত্ত্বিক বলেন হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার জন্যই ভারতে মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদ বেড়েছে ।হিন্দু মহাসভার নাম দিয়ে যদি কোন সংগঠন তৈরি হয় যারা স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেবে তারা স্বভাবতই nomenclature এর মাধ্যমেই মুসলিম সমাজকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। যেটা মার্কসবাদী পণ্ডিতরা অনেকে বলেন। এমনকি সুমিত সরকার এর মত ঐতিহাসিকও মুসলিম শূন্যতার কারন হিসেবে হিন্দুদের দায়ী করেন। যারা অভিজাত  হিন্দু ,যারা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কর্ণধার হয়ে উঠেছিলেন তারা মুসলিম বিচ্ছিন্নতা বাড়াতে সাহায্য করেছেন বলে অভিযোগ তোলা হয়। আবার মুসলিম সাম্প্রদায়িকরা তারা হিন্দু বিরোধী প্রচার এবং কাফের ও অচ্ছুত   করে রাখা হিন্দুদের সেটাও কিন্তু অনেক মুসলিম মৌলবীরা করেন, এমন নয় যে করেন না। তবে এই পরিস্থিতি টা থেকে বেরোনো আজ কিন্তু খুব বেশি জরুরি।

উপেন্দর সিং এর আগে প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক হিংসা নিয়ে একটি গবেষণা লব্ধ বই প্রকাশ করেছিলেন। সম্প্রতি আরেকটি নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে। বইটির নাম হচ্ছে 'ancient India culture of contradictions'. এই বইটাতে তিনি দেখিয়েছেন যে একটা স্টিরিওটাইপ ধারণা আছে।যে অতীতে রামরাজ্য ছিল এবং সেখানে কোনো রকম ভাবে হিংসার কিছু ছিলনা।

বাহ্যিকভাবে যারা মনে করেন বৈদিক যুগে হিংসা ছিল না এবং মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পর বিদেশি মুসলিম শাসকদের হাত ধরে ভারতে হিংসা এসেছে সেটা কিন্তু সত্য নয় । উপেন্দর সিং বিভিন্ন নথি এমনকি বেদের থেকেও বিভিন্ন উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন যে বৈদিক যুগেও কিরকম ভাবে racial conflict  হয়েছে। কিভাবে মেচ্ছ  বিরোধী আক্রমণ হয়েছে ।এছাড়া মেচ্ছরা বিভিন্ন নিচুতলার  যেরকম উপজাতিও    হতে পারে আবার  বিদেশি ও হতে পারে।এখানে বিদেশি মানে আমরা ধরে নিতে পারি ,হিন্দু হিসেবে পরবর্তীকালে তাদেরকে প্রমাণিত করা হয়েছে। একদিকে তথাকথিত হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠের ভারতে সংখ্যালঘু মুসলিমদের নিরাপত্তাহীনতায় এবং সেই সাম্প্রদায়িকতার পথে হঠাৎ এইটা কাঙ্ক্ষিত বিষয় নয়। আবার ইসলামী রাষ্ট্রে মুসলমান এবং মুসলমান সম্পত্তি কি হওয়া উচিত এবং সেটা নিয়ে কোরানে কি আলোচনা করা হয়েছে সেটা নিয়েও কিন্তু অনেকে অনেক রকম লেখালেখি করেছেন। সেটা আমরা অনেকেই জানি। তার কারণটা হচ্ছে একটা 'সেক্যুলার  পলিটিকাল অর্ডার' তৈরি হওয়া দরকার এটা কিন্তু অনেক মনীষীরাই বলে গেছেন। মুসলমান কেবল মুসলিম রাষ্ট্রে ইসলামিক জীবন যাপন করতে পারেন নিরবিচ্ছিন্নভাবে। কারণ তাহলেই মুসলমানকে কোন man-made law শিরোধার্য করতে হচ্ছে না। এই যে ভাবনা এই ভাবনাটা নিয়েও কিন্তু নতুন করে ভাবার দরকার আছে। অনেকে  অ-মুসলমান বিষয়টাকে ও কিন্তু খুব স্পর্শ কাতর বিষয় বলে মনে করেন মুসলিম সমাজে। যাদের জিম্মি (DHIMMI) বলা হয়। অর্থাৎ মুসলমান রাষ্ট্রের মুসলমান প্রজাসাধারণ। তাদের রাষ্ট্র কি আচরন করবে তা কোরানে স্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করা আছে ।ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার রেকর্ড দেখার দরকার নেই। লেখকরা ইসলামিক অর্ডারে বহুত্ববাদের সুযোগ আছে এটা স্পষ্ট করে  বলবার সুযোগ চেয়েছেন। বিশ্ব বিখ্যাত ইসলামবিদ গীব এবং বোয়েন তাহাদের প্রামাণিক গ্রন্থ 'Islamic society and the west dhimmi' শীর্ষক একটি অধ্যায় বলেছেন অটোমান সাম্রাজ্যে জিম্মি দের স্বীকার করা হয় । tolerated religious and ethnic  minorities  বলে চিহ্নিত করা হয় । এই প্রসঙ্গে বহুদিন আগে  ট্রাইটন উল্লেখযোগ্য কাজ করেছিলেন ।তিনি খলিফা ওমরের চুক্তি উল্লেখ করেছিলেন ।যে চুক্তির সারকথা ,যদিও জিম্মি আর্থিক প্রাধান্য ,সম্পদ অর্জন করতে পারে রক্ষা করতে পারে ,birthday lived on sufferance exposed to the caprices of the rules and passions mob. এ তো বহুদিন আগের কথা। কিন্তু আজও মুসলিম রাষ্ট্রে সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধি আচরণ করা হয়, পাঠকরা তো জানেন। অর্থাৎ ইতিহাস কিন্তু বদলাচ্ছে না।আজও মুসলিম সমাজ দুটো পৃথিবীতে বাস করে।মুসলমানরা আর  অন্যরা। আজও দেখা যাবে আমাদের দেশে ,অন্যত্র দেখা নিষ্প্রয়োজন। একটা অঞ্চল  হিন্দু অঞ্চল আর ওই অঞ্চল টা হচ্ছে মুসলমানদের অঞ্চল। এই ভাবে ভাগ করা। বিখ্যাত ইসলামবিদ Albert hoaurani ১৯৪৭ সালে 'মাইনোরিটি'জ ইন দা আরব ওয়ার্ল্ড' বলে একটা প্রামানিক  গ্রন্থ রচনা করেন।তিনি প্রধানত ইজিপ্ট নিয়ে কাজ করেছেন।তিনি দেখিয়েছিলেন যে একাধিক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মুসলিম রাষ্ট্রে নিরাপদে জীবন-যাপন করছে ।কিন্তু তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত টা পরিষ্কার ।the majority and the minority did not fully constituted National community. এই ছবিটা কিন্তু আরব দেশের সমস্ত মুসলিম রাষ্ট্রে। হোসেনুর রহমান লেখক এবং অধ্যাপক তিনি কিন্তু এই মুসলমান এবং মুসলমান সম্পর্ক নিয়ে বেশ কিছু কাজ করেছিলেন । তিনি কিন্তু দেখিয়েছিলেন যে মুসলমান শাসক অথবা বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মাননীয় নেতারা কেউই চায় না এই দু'পক্ষের একটা ঐক্যবদ্ধ  সমাজ তৈরি হোক।কারণটা অর্থনৈতিক।কারণ শরিয়াত সহনশীলতার কথা বলে ,বলে না সহাবস্থানের কথা। বরং বিধর্মীদের হীন মানুষ (infertility )অক্ষত থাকুক এই কথাটায় মত পোষণ করেন অনেকে। অন্য দেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে স্বদেশী ইতিহাসের মান কোথায় সেটা বোঝা যায়।  দক্ষিণ ভারতে ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ।উন্নত ব্রাহ্মণ  ধরে নিতে চান অনুন্নত অব্রাহ্মণ ব্রাত্য এবং আপত্তিকর।সেরকম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতারা তাদের সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠদের জীবন ও জগৎ সংসার থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চান ।এখন এই যে তফাৎ এই তফাৎটাই হচ্ছে কিন্তু সবথেকে বড় বিপদের কারণ। ইসলামে ভাবাদর্শ আর হিন্দুত্বের ভাবাদর্শ খুব কাছাকাছি স্থাপন করা যায় না । দুটো ভাবাদর্শের কথা আলাদা। কিন্তু ভাবাদর্শ দুটোই একটা তো নয়!এই ধর্মীয় ভাবাদর্শকে যখন পাকিস্তান রাষ্ট্র কর্মের স্বরূপ করে তুলতে উদ্যত হয়, তখন সেই দেশেরই চিন্তাশীল মানুষেরা চরম বিস্ময়ে বলেছিল যে রাষ্ট্র আবার আইডিওলজিক্যাল হয় কি করে । তৎকালীন উচ্চতম আদালতের মহামান্য বিচারপতি মুনির আইডিওলজিক্যাল প্রস্তাবকে কটাক্ষ করে বলা হয়েছিল, তাহলে তো সর্বভারতীয় দিক দিয়ে বিচার করে দেখতে হবে কে মুসলমান? সুতরাং ঠক বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে। মুসলমান আরেক মুসলমানকে মুসলমান বলে স্বীকার করতে চায় না। মুসলমান মুসলমানের যুদ্ধ লেগে যায়। রক্তগঙ্গা বয়েছে।  তারপরে পাকিস্থানে সেদিন প্রতিবাদ স্বরূপ রোমান ক্যাথলিক বিশপ জন জোসেফ বয়স তাঁর হয়েছিল ৬৭।আত্মহত্যা করেছিলেন ফায়াসলাবাদে।বেশ কিছুদিন আগের কথা হোসেনুর রহমান লিখছেন যে প্রতিবাদ রোমান ক্যাথলিক আইয়ুব ম্যাসির পাওনাদারদের বিরুদ্ধে। কেন এই মৃত্যুদণ্ডাদেশ?এহেন রোমান ক্যাথলিক ভদ্রলোক নাকি ইসলামের বিরুদ্ধে সমালোচনা করেছিলেন। পাকিস্তানের জেনারেল জিয়াউলের আমল থেকেই ঘৃণ্য ব্লাসফেমি আইন চালু করা হয়েছিল। তার ফলে কখনো কখনো সত্যের জ্যোতির্ময় পথ সুগম করার জন্য ধর্মযাজকদের প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছিল। এই বিসর্জনে  পাকিস্তানের ঘৃণ্য আইন অচিরেই অবলুপ্ত হয়ে যাওয়ার দাবি ওঠে। ক্যাথলিক ধর্মযাজকদের প্রাণ বিসর্জন এর সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের চারদিকে শোরগোল পড়ে যায়। একটা মাত্র সমাবেশে তাকে ১০ হাজারের অধিক নর-নারী, শিশু থেকে বৃদ্ধ এসে এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছেন সেই সময়।আইউব এর বিরুদ্ধে প্রাণদণ্ডের দাবি ওঠে। এই দাবি কেবলমাত্র খ্রিষ্টানরা করেননি ।মুসলমান করেছে ,হিন্দু করেছে সব ধর্মের মানুষ সমবেত হয়ে করেছে। পাকিস্তানের ধর্মীয় তৎকালীন সংখ্যালঘু মন্ত্রী রাজা জাফারুল হক তখন বলেন যে এই ব্লাসফেমি আইন কোন এক ধর্ম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে করা হয়না ,আয়ুব ম্যাসি নিশ্চয়ই আইনের সাহায্য নেবেন।মানবাধিকার কমিশনের সভাপতি এই কমিশন পাকিস্তানের ক্যাথলিক বিশপ  সম্মেলনের বলিষ্ঠ পদক্ষেপ ঘোষণা করেছেন, ম্যাসির বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পূর্ণরূপে একদল মানুষের  ষড়যন্ত্র।খ্রিস্টানদের জমি আত্মসাৎ করা চাই !চমৎকার! পাকিস্তান আর ইসলামকে কত কায়েমি স্বার্থ রাষ্ট্রে পরিণত করবে? এই প্রশ্ন তুলেছিলেন হোসেনুর রহমান।এই ট্রাডিশন সমানে চলেছে।এটাই হলো সবচেয়ে বড় বিপদের কারণ। আজকে যেভাবে হিন্দু এবং মুসলমান এর বিরোধ বাধে ভোটের রাজনীতি করা হচ্ছে সেটা কিন্তু বড় দুঃখের।


রাজ শেখর বসু তার একটি  প্রবন্ধ 'ভারতীয় সাজ্জাত্য' এই প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন,বাঙালি ও একটা সময়ে খাঁটি হিন্দু ,আর্য হিসেবে দাবি করত। এখন কিন্তু ক্রমশ বোঝা গেছে যে বাঙালি জাতিসত্তা কিন্তু শুধুমাত্র খাঁটি আর্য না, হলেও একটা মিশ্র জাতির সংস্করণ।

রবীন্দ্রনাথ  আত্মপরিচয় প্রবন্ধে লিখেছিলেন  যে, 'আমি হিন্দু সমাজে জন্মিয়াছি এবং ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় কে গ্রহণ করিয়াছি- ইচ্ছা করিলে আমি অন্য সম্প্রদায়ের যাইতে পারি, কিন্তু অন্য সম্প্রদায়ের যাব কি করিয়া।সে সমাজের ইতিহাস তো আমার নয়। গাছের ফল 1 ঢাকা হইতে অন্য ঢাকায় যাইতে পারে, কিন্তু এক শাখা হইতে অন্য শাখায় ফলিবে কি করিয়া।তবে কি মুসলমান না খ্রিস্টান সম্প্রদায়ে যোগ তুমি হিন্দু থাকতে পারে।নিশ্চয়ই পারি।.....…বাংলাদেশে হাজার হাজার মুসলমান আছে,হিন্দুরা অহর্নিশি তাহাদিগকে হিন্দু নও হিন্দু নও বলিয়াছে।তাহারাও আমাদিগকে হিন্দু নয় নই হিন্দু শুনাইয়া আসিয়াছে।কিন্তু তৎসত্ত্বেও তারা প্রকৃত হিন্দু মুসলমান। কোন হিন্দু পরিবারে এক ভাই   খ্রিস্টান, আর এক ভাই মুসলমান ও আরেক ভাই বৈষ্ণব হয়ে একই পিতা-মাতার স্নেহে বসবাস করিতেছে এমন কল্পনা করা কখনোই দুঃসাধ্য নয় । ......ইহাই যথার্থ সত্ত।কারণ মঙ্গলি যথার্থ সুন্দর। ....মুসলমান একটি বিশেষ ধর্ম,কিন্তু হিন্দু বিশেষ ধর্ম নহে।



 রাজ শেখর বসু এই  উদ্ধৃতিটি কে উত্থাপন করেছেন।  তিনি এটাকে খুব গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন যে রবীন্দ্রনাথ যে ব্যাপক অর্থে হিন্দু শব্দটি প্রয়োগ করেছেন সে অর্থে এখন চলার কোন সম্ভাবনা নাই। হিন্দু শব্দের আধুনিক  অর্থটা দাঁড়ালো যে ভারত  জাত ধর্মাবলম্বন। বৌদ্ধ ,জৈন ,শিখ ,সনাতন হিন্দু।কিন্তু মুসলমান, খ্রিস্টান হিন্দু নয়।যদি এই সংকীর্ণ সংঘাতের প্রচলন না হতো তথাপি কোনো মুসলমান 'হিন্দু নয়' এর অন্তর্ভুক্ত হতে চাইতো  না। রবীন্দ্রনাথ যে সাজ্জাত্য বোধ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন তা এখন ভারত নামের ওপর গড়ে উঠতে পারে। পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের মতে ন্যাশনালিটি এবার সাজ্জাত্যের কারণ হলো নিবাস উৎপত্তি (origin)ভাষা, ধর্ম ,ঐতিহ্য (tradition) সংস্কৃতিও স্বার্থের ঐক্য। কোন রাষ্ট্রে উক্ত কারণে সবগুলি না থাকলেও সজ্জাত্যের প্রতিষ্ঠা হতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উৎপত্তি আর ঐতিহ্যের ঐক্য নেই,ধর্মও(protestant ,Catholic,yahoodi)  সমান নয়। ভাষার ঐক্য প্রয়োজনের জন্য হয়েছে। কানাডারও একই অবস্থা সেখানে ভাষার ঐক্য নেই। সুইজারল্যান্ডে উৎপত্তি ,ভাষা, ধর্ম সমান নয়। সোভিয়েত রাষ্ট্রে নিবাস আর স্বার্থ ছাড়া আর কিছুr নেই ঐক্য নেই। ধর্ম ও সেখানে দুর্বল । তথাপি এসব রাষ্ট্রের অধিবাসীরা সজ্জাত্য লাভ করেছে।সমগ্র ভারত রাষ্ট্রের উৎপত্তি আর ভাষার যতই প্রভেদ থাক প্রদেশের বা রাজ্যে   প্রভেদ  সর্বোচ্চ নেই পশ্চিমবঙ্গে মোটেই নেই । স্বার্থও সকলের সমান।


ভারত পাকিস্তানের হয়ত অনেক সময় লাগবে। হিন্দু আর মুসলমান পরস্পরকে সন্দেহের চোখে দেখে একথা তো অস্বীকার করে লাভ নেই। অপরাধের কারণ নিয়ে দুপক্ষের অনেক বাদানুবাদ হয়েছে। তার অত আলোচনা না করে মিলনের উপায় খোঁজাটাই ভালো। এই মিলনের উপায় কিন্তু আজও আমাদের খুঁজতে হচ্ছে। যুক্তিহীন আতঙ্ক শিক্ষিত মুসলমানরা দূর করতে পারেন।হিন্দুরা যখন ভারতীয় বিদ্যার, কলা'র চর্চা করছেন তখন নির্বিচারে তারা আধুনিক শিক্ষা অনুসারন করে।মুসলমানেরা ও সেটা নিশ্চয়ই করবে। হিন্দুর দৃষ্টিতে যা অনবদ্য মুসলমান তা অব্দ্য মনে করতে পারে। হিন্দুর বিশ্বাস থাকতে পারে শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান তার চার হাত ছিল। তিনি অর্জুনকে বিশ্বরূপ দেখিয়েছেন । মুসলমানের কাছে এইসব কথা অসত্য হতে পারে। তার জন্য গীতা পড়া চলবে না এটা তো হতে পারে না!

আরব্য উপন্যাস আর ওমর খৈয়াম পরে হিন্দুরা আনন্দ পায় ।সুফি সাহিত্য তার ভালো লাগে। প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য পড়লে মুসলমানরা নিশ্চয়ই আনন্দ পেতে পারেন,হয়তো পানও। কয়েকজন উদার স্বভাব বাঙালি মুসলমান তাঁদের রচনা দ্বারা হিন্দু চিত্ত  জয় করেছেন। কবি কায়কোবাদ তার একটি কাব্যে হিন্দুর নায়িকার মুখে কালীর স্তব দিয়েছিলেন। তাতে কিন্তু কবির  ধর্মনাশ হয়নি ।সুতরাং উদারতাই প্রকাশ পেয়েছে  । কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর সর্বজনপ্রিয় কবিতা হিন্দু আর ইসলাম ভাবাদর্শ এর সমন্বয় করে যশস্বী হয়েছিলেন। সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর লেখার নতুন ভঙ্গির জন্য অল্প সময়ের মধ্যে অসংখ্য পাঠকের মন জয় করেছিলেন। তিনি নিজে সংস্কারমুক্ত বিশ্ব  নাগরিক । তাঁর রচনাযও ছিল সেরকম । সংস্কৃত ,আরবি, ইংরেজি, জার্মানি নানা ভাষা থেকে শব্দ আর বাক্য চয়ন করে স্বচ্ছন্দে আর নিপুণতার সঙ্গে তাঁর লেখা সন্নিবিষ্ট করেছিলেন। মাতৃভাষার জাতি নাশ তো তিনি করেননি!

তাই রাজ শেখর বসুর প্রেসক্রিপশন হলো, মুসলমান এই দেশের প্রাচীন ঐতিহ্যের চর্চা করলে শুধু হবেনা। ভারতের বাইরে থেকে মুসলমানরা  ঐতিহ্য নিয়ে এসেছে যার ফলে তাদের সংস্কৃতি বিশেষ রূপ পেয়েছে। হিন্দু কেও তা জানতে হবে। নতুবা ব্যবধানটা দূর হতে পারেনা ভারতের সকল সম্প্রদায়ের পক্ষে এই রকম পরস্পর পরিচয় আবশ্যক । কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার এই হিন্দু-মুসলমান ঐক্য বাড়ানোর সবরকম চেষ্টা করেছেন।


আমাদের দূর্ভাগ্য আজ বাংলাদেশে যে রকম ঘটনা ঘটছে ,আবার গুজরাতে কিংবা বাবরি মসজিদ ভাঙার দিন ভারতে যে রকম ঘটনা ঘটেছিল সেটাও ছিল নিন্দনীয় ।সুতরাং কোনো রাজনৈতিক দলের জার্সি গায়ে না দিয়ে নির্ভীক এবং সৎ চিত্ত নিয়ে আমরা সকলে মিলে গর্জে উঠব যে 'ধ্বংস নয় ,সৃষ্টি চাই।

অশান্তি নয় ,শান্তি চাই '।


No comments