DEHLIJ

অশোক দেব

কল্পনা ও অনুমানের ভ্যানতাড়া




প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পরে একটি অলিখিত সংগীত বাজে। মেদুর,সংজ্ঞাহীন। অযুত ইহুদি হত্যার পরে আর্যরক্ষার কী করলেন ফিউরর? কোথায় চেঙ্গিস খাঁর বিপুল বিস্তার? নিশান্ধকারে কয়েক অক্ষৌহিণীর রক্তগন্ধে ভরা কুরুক্ষেত্রের বাতাস কোন ধর্মকথা বলতে পেরেছে? কারবালার ময়দান থেকে কোনদিকে গিয়েছিল তৃষ্ণাতাড়িত মানুষের হাহা? এইসব প্রশ্নের উত্তরে সেই সংগীতের নিথর সুর ছাড়া কিছু মেলে না। 


তথাপি পশুমাত্রই রণপ্রিয়।সকলে নয়, কেউ কেউ। সামান্য শক্ত হলেই বাঘিনী তার শাবকের সঙ্গে হত্যা-হত্যা খেলে। এমনকি বেড়াল কিংবা শৃগালী। মানুষও খেলে। সামান্য আলোকশিখা হাতে নিয়ে কে যেন গুহার অন্দরে চলে গেল। পাথরে পাথরে এঁকে রাখল বিরাট বাইসনের করুণ হত্যারহস্য। কেন? প্রজন্মকে হত্যাশিক্ষা দেবার জন্যই তো।জঠরে অগ্নিসম্বল করে পৃথিবীতে আসে মানুষ। কিছুই দেননি প্রকৃতি তাকে। না কঠোর শৃঙ্গ, না বিষদাঁত, না গতি, না ভার ও সাম্য। নিতান্ত পরনির্ভর এক পশুকে নিজের রহস্যোদ্ধারের দিকে ঠেলে দিলেন। পথরেখা বলতে মগজে ভরে দিলেন নৃশংস কৌতূহল। 


নিরপেক্ষ কৌতূহল কত সুন্দর, না? ধনিক প্রতিবেশী কী করে ধন করেছে, সে নিয়ে অবান্তর কৌতূহল কাকে কষ্ট দেয়? তেমনি ঈশ্বর।আমাদের চিরধনাঢ্য প্রতিবেশী। কিন্তু, আকাশের পারেই কি তাঁর বাস? না হয়তো। না। যাদের জিজ্ঞাসা অপ্রসন্ন,তারাই তাঁকে দূরে নিয়ে বসিয়েছে। তাঁকে ডাকার ছলে, তাঁর ধনরাশির প্রতি নজর করে, কুকথা ছড়ায়। তাঁকে এক পেশল রাজার আসরে বসায়। কুৎসাপ্রচার করে, তিনি না কি খুশি হলে পুরস্কার আর বেজার হলে অগ্নিস্নান দেন। মিথ্যা। তিনি যে কত আপন প্রতিবেশী, কতই না আনন্দপরিবেশক আমরা জানলাম না। এই উপমহাদেশে এক লোক ছিলেন।আত্মবিরাজিত সেই মহারাজকে তিনি ‘কাছের মানুষ’ মনে করতেন। জিজ্ঞাসা করতেন, ‘কেন কাছের মানুষ ডাকছ শোর করে’?


অথচ শোরগোলে ভরে গেল আমাদের ডাকাডাকি। আর ডাকি না তেমন।ডাকার কাজে সত্যি শোর করা লাগে না। তাহলে? সেই যে অন্তর্গত রণপ্রিয়তাই আমাদের হীনতর করেছে। যা সুন্দর তাকে সুন্দর বলেই খুশি নই আমরা। সে কেন সুন্দর, কেন সে আমার অধিকারে নেই? এই হল পাপকৌতূহল। মানুষের ‘প্রগতি’ তার বশ। পদার্থের নাড়ি ঘেঁটে নৃত্যরত শান্তিময় পরমাণু আবিষ্কার করে নিবৃত্তি নেই তো।পরমাণুর নৃত্যের গভীরে যে তাণ্ডব, তাকে ছিঁড়ে এনে ছুঁড়ে দিতে হবে অপরের দিকে। বিষলতা তেমনি ছিল। না, তিরের গায়ে তার বিষটুকু মেখে পেড়ে আনতে হবে আকাশের পাখি। কেমন পশুসঙ্গ করতে করতে কে যেন বুঝে ফেলেছিল বিরাট হস্তিনীর ভাষা। নিগুঢ় সেই ভাষার বলে সে দখল করেছিল তাদের পুরো সমাজ। অথচ কারা তাদের ধরে এনে রণক্ষেত্রে শত্রুপেষণের কাজে নিয়োজিত করল? করে কী হল?


ভাষা আবিষ্কার করেই যেন দূর হয়ে গেলাম পরস্পর। কেউ কারো কথা বোঝে না আর । ইশারা-ইঙ্গিতে, নয়নবিক্ষেপে যে প্রাণবিবরণ দেওয়া যেত, তা বন্ধ হয়ে গেল। কতগুলো কৃত্রিম ধ্বনির দাস হয়ে গেলাম আমরা। এই দাসত্ব যে কত করুণ, জানা গেল পরে। যেদিন মানুষ ভাষাহীন বাদ্যযন্ত্র আবিষ্কার করল সেদিন। আহা মুক্তি, মুক্তি! বাঁশরীর কেবল ধ্বনিটুকু আছে, কথা নেই। সে ধ্বনিকাতর নারীটিকে মনে আছে, যার পায়ে পায়ে জোছনা ধূলোর মতন কুঞ্জগেহে গিয়ে হেসে হেসে সুর হয়ে যেত? নেই, থাকে না মনে। কারণ, তারপরেই তো আসে কথার কারুকাজ। এই কারুকাজে আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী, ঈশ্বর , দূরে চলে গেলেন। কারা যেন বলল, তিনি আর আমাদের কথা বুঝতে পারেন না। তাঁর ভাষা ভিন্ন। কারা যেন তাঁর নিজস্ব মুনশি হয়ে আমাদের জন্য নামিয়ে আনলেন গ্রন্থ। আর এইগুলোর ভাষা আমরা বুঝি না। বুঝি না জটিল সব কথার গোলকধাঁধা। যেখানে ধাঁধা, সেখানেই কিছু বাজিকরের উদ্ভব হয়। এরা বাজিকর, এরা বাজিকর। আমাদের তাঁর নামে নাচায়, চোখ খুলে আনতে বলে ভাইয়ের। আমরা তাই করি, করে এক রক্তাক্ত বিশ্রামের দিকে যাই। তাকেই ধর্মীয় সন্ত্রাস বলে। 


রাজার সঙ্গে চিরকাল বাজিকর থাকে। টিকি পরা, জোব্বা পরা, গাউন পরা এইসব বাজিকর তার কানেকানে বলে, রক্ত খাবেন ঠাকুর, রক্ত খাবেন। রাজা আত্মবিরাজিত ঠাকুরকে প্রশ্ন না করেই রক্ত আনতে যায়। বাজিকর তার পিছুপিছু তারই পুত্রকে পাঠিয়ে দেয় রক্ত আনো, রক্ত আনো। কতবার পৃথিবী ধ্বংস হয়েছে এদের লোলুপ শবসাধনায়। আমাদের বুঝবার কথা ছিল, বুঝিনি। আরেকদল বাজিকর আছে রাজাদের গায়ে গায়ে এঁটুলির মতন। তারা যন্ত্রবিশারদ। প্রতিদিন নানা কল আবিষ্কার করে রাজাকে চমকে দেয়। আধুনিক রাজ্যেশ্বর সেসব বাজারে পাঠায়।আমাদের প্রাচীন দাসবৃত্তি এখন যন্ত্রের পায়ে লুটিয়ে পড়েছে। রান্নায়, স্নানে, কথায়, গানে, শ্রমে-বিশ্রামে, আদরে-ক্রন্দনে কেবল যন্ত্র। আমরা আর নিজেদের কাছে নিজেরা উপযুক্ত নই। কে যেন কোথায় প্রযুক্ত করে দিচ্ছে। সেই প্রযুক্তিবাজিকরের তালে পড়ে আমাদের বিকাশ গেল আটকে। অনুমান,মানুষ আর বাড়ছে না। যে প্রগতির হাত ধরে একটিমাত্র কোষ থেকে বিকশিত হতে হতে মানুষ গগনবিজয়ী হয়েছিল, সে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। মানুষের ইভ্যুলিউশন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। নাহলে কবে কোন প্রাচীন লোকের লেখা গ্রন্থের গর্বে সে গর্বিত হয়? অস্ত্র হাতে গ্রন্থরক্ষায় ছুটে যায়, কাকে মারবে জানে না, নিজেও মরে যাবে — জানে না। একেই বলে ধর্মীয় সন্ত্রাস। 


অথচ, নিজেকে নিবিড় করতে কারা যেন বনপথে চলে গিয়েছিল বনের অনেক গভীরে। নিজেতে ডুব দিয়ে তুলে এনেছিল প্রচুর গোমেদ। কামনা করেছিল, ত্রিবিধ বিঘ্নের শান্তি। বলেছিল : 

‘সর্বে ভবন্তু সুখিন,

সর্বে সন্তু নিরাময়া,

সর্বে ভদ্রানি পশ্যন্তু,

মা কশ্চিদ দুঃখ মাপ্নুয়াত,

ওম শান্তি শান্তি শান্তি’


জোছনালালিত রাতে কে যেন স্ত্রীপুত্র রেখে জরানিরসনে মেদুরতর জোছনা শিকার করতে গিয়েছিল। আত্মলোপ করে ফেলে নিজেই নিজের জন্মদান করে বলেছিল, নাশ করো দুঃখের কারণ, তাতেই সুখবৃদ্ধি হবে। সেই কারণ ও ফল নিজেতেই বসবাস করে।


প্রেমহীন, বারিশূন্য পৃথিবীতে তারকাসাক্ষী করে জগতে এসেছিল এক ছুতারপুত্র। বলেছিল, ভালোবাসো, ভালোবাসো। তিনি তোমাদের ভালোবাসেন। 


মরুশীত উপেক্ষা করে এক গুহার অভ্যন্তরে চলে গিয়েছিল এক মধ্যবয়স্ক মানুষ। ফিরে এসে বলেছিল, একা খেয়ে ফেলো না সকল উপার্জন, দেখো ভাই উপবাসী। 


এইসব ফেলে আমরা আছি বাজিকরের অধীনে। কঠোর এক স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রয়োজন হল আজ । বাজিকরের শেকল ছিঁড়ে চলে আসতে হবে নিজের অধীনে। তিনি তো সহবাসী আমার, শিখতে হবে তাঁর সঙ্গে নিবিড় সহবাসের আসন ও মুদ্রা। পবিত্র আত্মনিগ্রহ যে শিখেছে, অপরের নিগ্রহসাধনে তার সময় কোথায়?  



No comments