সম্পাদকীয়
ধর্মসন্ত্রাস - বিশ্বাস্য সেইসব ধারণা - যেখানে পাখি মানে আগুন । আর ধর্ম মানে ঝরে পড়া পালকের ছাইসর্বস্বতা ।
ধর্ম একটা বিশ্বাস । সন্ত্রাসও একটা বিশ্বাস । অধিকিন্তু , ধর্ম সুপারলেটিভ । অর্থাৎ সন্ত্রাসের একটা ধর্ম আছে ।
ইহ এক বিশ্বাস্য ব্যাকরণ যে অন্য গ্রহের মতোন আমাদের এই পৃথিবীটাও গোল । গোল বলতে ঠিক গোল নয় । খানিকটা নাশপাতির মতো । ঠিক আবার নাশপাতির মতোও নয় । কিছুটা কমলা লেবুর মতো বলা যায় । ঠিক, এই ভাবে শিশুমনে আমাদের ধারণা করাঃ এই পৃথিবী গোল ।
এইভাবে আমরা বুঝতে পারছি পাহাড় থেকে নদী নেমে আসছে, নদীতে বয়ে যাচ্ছে জলের স্রোত ধারা , এই সব ঘটনা চিরন্তন বা শাশ্বত । নদীর তীরে গড়ে ওঠা জনপদ একটি সত্য । মরুভূমির জলাশয় একটি মরীচিকা অথবা একটি মিথ্যা, এই সমস্ত নিয়েই আমাদের ধারণা ।
আমাদের 'ধারণা' মানে কী ? মানে যেটা দেখি, নাকি যেটা শুনি, নাকি যেটা বুঝি ? নাকি যেটা পড়ি ? নাকি যেটা প্রমাণিত ?
হয়তো , এই সমস্ত চরাচর মিলেই শিশুর এই সৌরজগৎ ধারণা (Concept) । 'ধারণা' তখনই 'বদ্ধমূল ধারণা' হয়, যখন শিশু পড়তে শেখে । অন্যভাবে বলা যায় মনুষ্যজাতি 'বই' পড়েই বেশী শিক্ষা লাভ করেন । এই যে এতো সব লেখালেখি বা সাহিত্য, এইসবের পিছনেও রয়েছে কিতাব । কোথাও ভুলচুক হলে, অন্যান্য পণ্ডিতবর্গ এসে যথাসময়ে ভুল ধরিয়ে দিয়ে, কোট করে বলবেন, "এই যে বকোদর, অমুক গ্রন্থে এইটা সঠিক ভাবে লেখা আছে , কথাটা হলো এই ..." ।
ধর্মও কি একটা ধারনা ? কোথাও সেটা লেখা আছে ?
নিশ্চয় লেখা আছে । কোথাও ।
তাহলে সন্ত্রাস কী ? সেটাও কি কোথাও লেখা আছে ?
সন্ত্রাস বুঝতে হলে কোন কিতাব পড়তে হবে ? কোন গ্রন্থ আছে নাকি ? অর্থাত সংঘটিত সন্ত্রাস করার জন্য নিশ্চয় কোন শ্লোক বা আয়াত আছে কোথাও । সেই আয়াতে বা শ্লোকে যাওয়ার আগে আরো দু একটি প্রশ্ন জেনে নেওয়া যাক ।
কোনটা ধর্ম । যা ধারন করে । ধারন বা কি আর ধারণাই বা কি ? এই যে প্রতিদিন ভোর হয়, আমরা ঘুমাতে যাচ্ছি রাত হলে । সূর্য পশ্চিমে সন্ধ্যায় ঢলে গিয়ে সে আবার পূর্ব দিকে উদিত হচ্ছে । এটাই কি ধর্ম ? নাকি এটা কোন সূত্র ? গীতা, কোরআন, বাইবেল কি বলছে ? মহামান্য চার্চ কি বলছে ? মন্দির , মসজিদের মালিক । এই সমস্ত ধারনায় একটা স্ট্যাম্প লাগা জরুরী । যেটা লিখিত নয়, সেটা সত্য নহে ।
সূর্যের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত ইউনিভার্স আমাদের পশ্চিমে ডুবে যাচ্ছে । এক কথায় বলা যায় তারা পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে । আমাদের মনে হচ্ছে , সেই সব একটা নিয়ম, আমরা লিখে ফেলছি । আমাদের ধারনাকে বদ্ধমূল করে লিখিত বিষয় ।
এই রকম সমগ্র বিশ্ব ও মহাকাশ নিতে আকাশপাতাল এক সময় তা লিপিবব্ধ করে ফেলেন টলেমী অর্থাত ভূগোলবিদ ক্লডিয়াস টলেমিয়াস (প্রাচীন গ্রিক: খ্রিস্টপূর্ব ৯০ – খ্রিস্টপূর্ব ১৬৮) । তিনি, আমাদের জানালেন সমস্ত মহাকাশ ও জগত আমাদের পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে । সেটা জিওসেন্ট্রিক তত্ত্ব ।
১৫০০ বৎসর ধরে ছিলও সেইটা সত্য । সেইটাই ধর্ম । কারণ তার উপর ছিলো ধর্মমালিকের হস্তাক্ষর বা চার্চের স্ট্যাম্প । এবং সেই সেইটাই বিশ্বাস্য সত্য । যতদিন না 'হিলিওসেন্ট্রিক' সৌরজগতের বিশ্বাস্য নিয়ে হাজির হন কোপার্নিকাস (নিকোলাস কোপের্নিকাস ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৪৭৩ - ২৪ মে ১৫৪৩) । যেহেতু চার্চ এই সব বিশ্বাস করেন না । এইগুলি লিখিত সত্য নয়, এইগুলি আসমানী কিতাবের শ্লোকে নেই । সেই সত্যের বিপক্ষে কোপার্নিকাস জীবদ্দশায় কিছু লিখে যেতে পারলেন না । ধর্মের অনুভূতিকে আঘাত করা মানে, ফাঁসীর দড়ি অথবা হেমলক পান বা মৃত্যু । এইটুকু পড়াশোনা তার করা ছিলো ।
লিখে যাওয়া জিনিস হলো, অনুসিদ্ধান্ত । তাতে, ধর্মের স্ট্যাম্প লেগে তা সত্য হয়ে যায় । সে কথা জানতেন ইতালীয় পদার্থবিজ্ঞানী, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, গণিতজ্ঞ এবং দার্শনিক গ্যালিলিও গ্যালিলেই ( জন্ম: ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৫৬৪ - মৃত্যু: ৮ জানুয়ারি, ১৬৪২) । তিনিও বিশ্বাস করতেন কোপার্নিকাসকে । কোপার্নিকাস বলতে চেয়েছিলেন - মহাবিশ্বের কেন্দ্র পৃথিবী নয় , পৃথিবী নিজেই ঘুরে চলেছে । কিন্তু বাইবেল কি বলে ? চার্চ বলছে, পৃথিবীই মহাবিশ্বের কেন্দ্র । দশচক্রে তো ভগবান ভূত । তাই উল্টো বললে, বাইবেলের অবমাননা হয় । গুরুজনেরা বলেন, হে গ্যালিলিও তুমি সত্য জানো না । আরও একটু বাইবেল তুমি পড়াশোনা করো । আরো একটু বিদ্যে তুমি আরোহণ করো । ভিতরের সত্য তুমি জানো ।
১৬৩০ খ্রিস্টাব্দে গ্যালিলিও রোমে ফিরে যান তাঁর রচিত একটি বই ডায়ালগ কনসার্নিং দ্য টু চিফ ওয়র্ল্ড সিস্টেম্স প্রকাশের লাইসেন্স নেওয়ার জন্য। সেখানে গ্যালিলিও নিজ বিশ্বাস ও ধারণার জন্য ( অন্যভাবে বলা যায়ঃ চার্চ ও পবিত্র খ্রিষ্ট ধর্ম অবমাননার জন্য ) অক্টোবর মাসে তাঁকে রোমের পবিত্র দপ্তরের (Holy Office) সম্মুখীন হতে হয়। আদালত থেকে তাঁকে একটি দণ্ডাদেশ দেওয়া হয় যার মাধ্যমে তাকে পূর্ববর্তী ধ্যান-ধারণা শপথের মাধ্যমে পরিত্যাগের জন্য বলা হয় । ওই দণ্ডাদেশের কার্যকরতা প্রমাণের জন্যই তাঁকে সিয়েনায় একঘরে জীবন কাটাতে হয়।
অথচ, এই ২০২১ খ্রীস্টাব্দে দাঁড়িয়ে আজ আমাদের এইটুকু ধারণা হয়েছে, ধারণা ভেঙ্গে যায় ।
এবং এটাও ধারণা করা যায়, যে কোন কিতাব এই চলয়মান সময়ের এক্সিসে ভুল হয়ে যেতে পারে । কিছুই নির্ভুল নয়, কোন জ্ঞানই আবসোলিউট নয় । এই হেলিওসেন্ট্রিক দুনিয়াতে আজ আপনাদের নিশ্চয় বলতে লজ্জা করে যে সূর্য পৃথিবীর চারিদিকে ঘোরে । পৃথিবীর যেটা ধর্ম মনে হয়েছে, ধর্মের যেটা ধর্ম মনে হয়েছে , আসলে সেটা ধর্ম নয় ? এইটাই পড়াশোনার ধর্ম । অর্থাৎ ধর্ম অবমাননা একটি মধ্যযুগীয় ঘটনা, যার জন্য ২০২০ খ্রীস্টাব্দের অনেক ধর্মযাযকেরা ১৬৩২ এর গ্যালিলিওর কাছে পসথুমাস ক্ষমা চেয়েছেন ।
তাহলে এতো রক্ত কেন ? এতো সন্ত্রাস কেন ? সন্ত্রাস ও একটা বিশ্বাস ও যোগ্যতমের উদবর্তন । কারা যোগ্য সেটা কোন কিতাবে লেখা নেই । সেই সমস্তই একটা ধারনার উপরে গঠিত । কারা খাঁটি সন্ত্রাসী, কারা জাল সন্ত্রাস এই নিয়ে কোন আসমানী ঘোষণা নেই, কোন উপদেশ নেই । বরং এগুলিকে বলা যায় ধর্মের পরিপূরক । এও একটি ধর্ম যা ধারণ করা হয় । যেমন 'জাতীয়তাবাদ' একটি ধারণা যা ধর্ম থেকেই জাত । আমাদের স্বার্থ কিভাবে সিদ্ধ হয়, সেই অনুযায়ী ঘোষণা করা হয় কে শহীদ বা সন্ত্রাসী । একটা টেবিলের কোন পার্শে লেখকের অবস্থান, তাই নিয়ে লিখিত হয় সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ ।
সেখানেও চলে আসছে রচনা । তবে, রচনার জনপ্রিয়তা হ্রাস চরমভাবে হ্রাস পেয়েছে ইদানিং । রচনার বিশ্বাস্য নিয়ে এখন আর কোন ধারণা তৈরি হয় না । রাস্ট্রধারনাও একটি অতীত । আটলান্টিস চার্টার (আটলান্টিক চার্টার ১৪ ই আগস্ট, ১৯৪১ তারিখে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জারি করা একটি নীতিগত নীতিমালা । সেই ধারনা অনুযায়ী, প্রত্যেক জাতি, একটি জাতীয়তাবাদের উৎস । সেখানে ধর্মগত সন্ত্রাস নিয়ে বেশীদিন চলা যাবে না । এই ধারনাটিও ততদিন বলাবৎ থাকবে, যতদিন না আর একজন গ্যালিলিও এসে সমস্ত জাতীয়তাবাদের ধারণা ভেঙে দেন ।
এই তো ভাঙছি আমরা । আমরা ভঙ্গুর । সন্ত্রাস অর্ধসত্য, তা ধর্মের পরিপূরক । মন্দির একটি ধাঁধাঁ । এই মহল্লায় কংক্রিটের জঙ্গল বেড়ে উঠেছে । পুরানো মসজিদের পেছনে যে ভ্যারান্ডা জঙ্গল ধাঁ ধাঁ করে বেড়ে যাচ্ছে, সেইটা হলো প্রকৃত সত্য ।
সত্য এবং ধারণা নিয়ে যখন এত কথা হচ্ছে,কবি বিনয় মজুমদারকে কোট করা যায়ঃ
"এ-সত্য জেনেও তবু আমরা তো সাগরে আকাশে
সঞ্চারিত হ'তে চাই, চিরকাল হ'তে অভিলাষী,
সকল প্রকার জ্বরে মাথা ধোয়া আমাদের ভালো লাগে ব'লে
তবুও কেন যে আজো, হায় হাসি, হায় দেবদারু,
মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়!"
Social Media Comment