সৌরাংশু
সাম্প্রতিককালের কিছু ধার্মিক হিংসা এবং তার প্রেক্ষিত
নিহাং অর্থাৎ অকালি অর্থাৎ অবিনশ্বর সৈন্য। গুরু গোবিন্দ সিং-এর পুত্র ফতেহ সিং এই গোষ্ঠীর সূচনা করেন। নীল রঙের পোশাকে ঐতিহ্যবাহী অস্ত্র নিয়ে ঘোড়ার পিঠে চেপে এঁরা স্বঘোষিত ধর্মরক্ষক। অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে গেলে আপনি এঁদের রক্ষীর বেশে দেখতে পাবেন।
তা মাস খানেক আগে এই নিহাং শিখরা শিরোনামে চলে আসে। কী হয়েছিল?
দিল্লির উত্তর পশ্চিমে সিঙ্ঘু সীমান্তে প্রায় এক বছর ধরে পাঞ্জাবের কৃষকরা নতুন কৃষি আইন সংস্কারকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে অবস্থান বিক্ষোভ করছেন। এখানেই লখিন্দর সিং বলে এক তফশিল্ভুক্ত দিনমজুরের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে যে তিনি শিখদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থকে অবমাননা করেছেন। কী ভাবে? তাঁর কাছে নাকি খানাতল্লাশি করে একটি দোমড়ানো মোচড়ানো গ্রন্থসাহেব পাওয়া যায়।
নিহাং শিখের একটি উপগোষ্ঠীর তিনজন নাকি এটা দেখতে পেয়ে প্রথমে লখিন্দরের হাত পা কেটে দড়ি দিয়ে উলটো করে তাকে গাছের সঙ্গে বেঁধে ঝুলিয়ে দেয়। রক্তপাতে লখিন্দারের মৃত্যু হয়। ধর্মীয় চরমপন্থী সংগঠনগুলি লখিন্দরের এই কাজের সমূহ নিন্দা করে এবং তাঁর শাস্তিকে কম বেশি প্রশংসা। কৃষক সংগঠনগুলি অবশ্য সম্পূর্ণ বিষয়টি থেকে নিজেদের দূরত্ব বজায় রেখেছে এবং এইরকম ভয়ঙ্কর কাজ যাঁরা করেছে, অর্থাৎ হাত পা কেটে উলটো করে ঝুলিয়ে দেওয়া, তাদের শাস্তি দাবী করেছে।
একটু জিজ্ঞাসাবাদের পর জানা গেছে যে তরণতারনে লখিন্দরের বাস এবং বেশ কিছুদিন যাবত মাদক সেবনের চিকিৎসা চলছিল তাঁর। কীভাবে তিনি তরণতারন থেকে চারশরও বেশি কিলোমিটার সফর করলেন, অশক্ত, চিকিৎসাধীন লখিন্দর তা করতে অক্ষম বলে তাঁর পরিবার দাবী করেছেন এবং কী করেই বা তাঁর কাছে নিহাংদের নীল পোশাক এল বা গ্রন্থ সাহেব দোমড়ানো অবস্থায় পাওয়া গেল, সে তদন্ত সাপেক্ষ।
সেসব চলছে। রাজনীতি, ন্যায়নীতি এবং ধর্মীয় ভাবাবেগ নিয়ে চুলচেরা তর্কও। আমরা বরং এসব ছেড়ে অন্য একটি ঘটনায় চলে যাই।
২০২১ অর্থাৎ ১৪২৮ বঙ্গাব্দের দুর্গাপূজার সময় বাংলাদেশের কুমিল্লায় একটি পুজো মণ্ডপে হঠাৎ করে একটি কোরাণ পাওয়া যায়। প্রশাসন সতর্কতা নেওয়া সত্ত্বেও উত্তেজিত জনতা শুধু সেই মণ্ডপটিই নয়, সারা কুমিল্লা জেলার বিভিন্ন মণ্ডপে হামলা করে। অবশ্যই বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় হামলা করে। একজন সংখ্যালঘুর মৃত্যুও হয়। এরপর হামলা, (হ্যাঁ অবশ্যই হামলা, দাঙ্গা নয়) ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন জেলায় জেলায়। চট্টগ্রাম, ফেনি, নোয়াখালি, রংপুর, বান্দরবান জেলা। চাঁদপুরে তো জনা চারেকের মৃত্যুও হয়।
ঢাকায় জুম্মার নামাজের পর প্রায় দশহাজার জনতার মিছিল নামে ‘ইসলাম বিরোধীরা নিপাত যাক’ বলে, ১৬ই অক্টোবর। প্রশাসনের টনক নড়ে। বাংলাদেশ সরকার কড়া হাতে ‘দাঙ্গা’ বা ‘হামলা’ দমনের কথা ঘোষণা করে। বাংলাদেশের মধ্যেই শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষদের প্রতিবাদ শুরু হয়। এমন কি চরমপন্থীদের ঘনিষ্ঠ বিএনপি পর্যন্ত সংখ্যালঘুদের উপর এই আক্রমণের তীব্র নিন্দা করে। বিষয়টি রাষ্ট্রসঙ্ঘেও উত্থাপিত হয় এবং রাষ্ট্রসঙ্ঘ থেকে বাংলাদেশকে সতর্ক করা হয়।
উপরে দেখবেন কতকটা ইচ্ছা করেই হিন্দু-মুসলিম শব্দগুলি ব্যবহার করিনি। কেন? সে বিষয়ে পরে আসছি। পরবর্তীকালে তদন্তে জানা যায় যে ইকবাল হোসেন নামক এক ব্যক্তি নাকি এই কোরান রেখেছিলেন অসদুদ্দেশ্যে।
এর প্রত্যুত্তরে ত্রিপুরা থেকে খবর এল যে ত্রিপুরায় বিশ্ব হিন্দু পরিষদ নাকি কম বেশি ১৬টি মসজিদ ধ্বংস করে দিয়েছে।
আর এসব ছাড়াও ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাতের জন্য সিনেমার শ্যুটিং বন্ধ, চিত্র প্রদর্শনী ভাংচুর, এমন কি সাম্প্রতিক কালে হত্যাও আমরা প্রায়শই দেখতে পাই।
ধর্মকে এক প্রাচীন ব্যাপার স্যাপার ধরে নিয়ে যদি এগোই তাহলে দেখতে হয়, ধর্ম কী এবং মানুষের ধর্মের প্রয়োজন হল কেন! আসলে ধর্ম হল আধার। মানুষ যখন গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে কোনও এক জায়গায় স্থিতিশীল হল তখন দরকার পড়ল কিছু নিয়মকানুন, বন্ধনের। মানুষকে সংঘবদ্ধ, সাংসারিক জীবে পরিণত করার জন্য এলো নিয়মাবলী। এর সঙ্গে যুক্ত হল যা দেখা যায় না, যা ছোঁয়া যায় না বা যা বোঝা যায় না তাকে সম্মান জানিয়ে কার্যকারণ অবস্থা নিমিত্ত সমস্তকে এক সুচারু রূপে ধরার চেষ্টা। সর্বশেষে এল ভবিষ্যৎ জীবন বা জীবনোত্তর জীবনকে সুরক্ষিত করার চেষ্টা। এল দর্শন। এল আচার আচরণ নির্ধারক সংহিতা। দর্শন সব মানুষের কাছে খুব স্পষ্ট না হলেও আচার সংহিতা মানুষের জন্য নিয়ে এল কিছু অবশ্যকর্তব্য বিশেষকে। ভবিষ্যতকে এক বৃহত্তর শক্তির হাতে দিয়ে মানুষ নিশ্চিন্ত হল আর নিয়ম নিষ্ঠার বেড়ায় নিজেকে বেধে তার অবস্থানকে আরও সুদৃঢ় করল। ধর্মগ্রন্থ তৈরি হল, সামান্য দর্শন আর অসামান্য নিয়ম বা আচার সংহিতা নিয়ে।
সব মানুষের কাছে দর্শন ধরা দিল না, কিন্তু পরজন্ম বা ভবিষ্যতের চিন্তা এবং বর্তমানের যাপনকে মাথায় রেখে তারা মনোনিবেশ করল আচরণ সমূহের উপর। ফলতঃ ধর্মগ্রন্থগুলি হয়ে উঠল মানুষের জীবন ধারণের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশাবলী।
সময় পাল্টালো, মানুষের যাপন পাল্টালো। কিন্তু ধর্মগ্রন্থের নির্দেশাবলীতে বদল হল না। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গীতে বদল হল, কিন্তু ধার্মিক চিন্তনে বদল হল না। বা বলা যেতে পারে সংখ্যাগুরু মানুষ দর্শন নিয়ে মাথা ঘামালো না, শুধুমাত্র বহু যুগের বাসি হয়ে যাওয়া কিছু নিয়ম কানুনকে মনে রাখল। সেটাই সহজ। ঐতিহ্য-ট্র্যাডিশন শব্দটি এতটাই ভারী যে তার তলায় চাপা পড়া থেকে বেরনো মুশকিল।
উপরের যে কটি ঘটনার উল্লেখ করলাম। সেগুলো আবার আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেল যে মানবসমাজকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য মানুষ যে ধর্ম তৈরি করে ছিল, তাই আজ ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের দানবের মতো স্রষ্টাকেই শেষ করতে উদ্যত। মানুষ নয়, ভেদাভেদের মাধ্যমে ধার্মিক আচরণবিধি এবং তার আকরের সম্মান সাধারণ মানুষের থেকে অনেক বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষ ছাড়া ধর্ম হয় না, ধর্মপালন করতে গেলে মানুষ দরকার। আর বিশ্বের কোনও ধর্মই আদতে বিদ্বেষের কথা বলে না। বলে না আমার ধর্ম অন্য ধর্মের থেকে সেরা। যা বলে সেটা পরবর্তীকালে গঠিত কিছু রীতি নীতি। নিজের ধর্মকে সম্প্রসারণের জন্য এবং সংকুচন থেকে বাঁচানোর জন্য বানানো হয়তো।
কাণ্ড আর জ্ঞান, মান আর হুঁশ নিয়েই মানুষ তৈরি। ধর্ম তৈরি সেই মানুষকে বাঁচাতেই। আর উভয় বস্তুই যখন ধর্মরক্ষার নামে বানের জলে ভেসে যায় তখন মানুষ তো বাঁচেই না, ধর্মও যে বাঁচে এ কথাও কি আমরা হলফ করে বলতে পারব? হ্যাঁ পারব, ধর্ম বাঁচাতে গেলে ধর্মের দর্শনকে বাঁচাতে হবে এবং সবার আগে বাঁচাতে হবে মানুষকে। অদূর ভবিষ্যতে আশা দেখি না, কিন্তু উত্তর পৃথিবীতে? উত্তর খোঁজার জন্য নিরন্তর সংগ্রাম করে যেতে হবে মানুষকে। এই সংকল্পই আগামীর পাথেয় হয়ে উঠুক।
এই কথাগুলোই বারংবার বলার চেষ্টা করে দেখেছি কিছু মুষ্টিমেয় "ধার্মিক" মানুষ/বন্ধু রে রে করে তেড়ে আসে। তুমি বললে মনের কথা। বলতে থাকো। একদিন হয়ত সবাই বুঝবে "সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই"
ReplyDelete