DEHLIJ

অমিত গোস্বামী

 ‘স্টপ জেনোসাইড’ বাংলাদেশ  





অন্যধর্মী নাগরিকদের নির্মম নির্যাতনে যখন স্বজাতি কর্তৃক বিতাড়িত অবস্থায় মহানবী (সঃ) জন্মভূমি মক্কা ত্যাগ করে মদিনায় হিজরত করছিলেন, তখন তিনি বারবার মক্কার দিকে ফিরে তাকাচ্ছিলেন আর কাতর কণ্ঠে আফসোস করে বলেছিলেন, ‘হে আমার স্বদেশ! তুমি কতই না সুন্দর! আমি তোমাকে কতই না ভালোবাসি। আমার আপন গোত্রের লোকেরা যদি ষড়যন্ত্র না করত, আমি কখনো তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।’ বাংলাদেশে হযরত মুহাম্মদ(সঃ)-এর  অনুসারীরা গত ৭৫ বছর ধরে সনাতন ধর্মীয়দের সাথে সেই ব্যবহার করছেন যা ইসলামের মহানবীর সাথে নিজদেশে তার স্বজাতিরা করছিলেন। তীব্র যন্ত্রণাভোগের পরে মহানবী যেভাবে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন এভাবেই বাংলাদেশ থেকে ক্রমে ক্রমে হিন্দুরা ভারতমুখী হয়েছে। এবারের দুর্গাপুজোয় ঘটে যাওয়া ঘটনাক্রম শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন কিছু ইসলামধর্মীয় মানুষের কলমে এই সনতন ধর্মীয়দের নির্যাতনের স্বীকৃতি প্রকাশ পাচ্ছে বারেবারে। এবারের সহিংসতা সম্ভবত সব মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে বলেই এই স্বীকারোক্তি উঠে আসছে বারেবারে। এবারের ঘটনাগুলি মোটেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নয়। দাঙ্গায় অংশ দুই তরফের থাকে। এ তো স্রেফ একতরফা আক্রমণ। ঝাড়েবংশে নির্মূল করার মতলব। 

বাংলাদেশে পারিবারিক শিক্ষাই শুরু হয় সনাতন বিদ্বেষ দিয়ে। পিঁপড়ের উদাহরন শেখানো হয় যখন একজন মুসলমান শিশু তার প্রাথমিক জ্ঞানলাভ করে। কি শেখানো হয় ? বলা হয় লাল পিঁপড়ে (এ বঙ্গে কাঠপিঁপড়ে বলে) হল হিন্দু মালাউনের জাত, সমানে কামড়ায়, এদের দেখলেই মারো। আর কালো পিঁপড়ে ( এবঙ্গে ডেঁয়ো পিঁপড়ে বলে) হল মুসলমান, তারা ভাল, কামড়ায় না। সে ছোটবেলা থেকে শেখে একজন সনাতন মানে বজ্জাৎ, ‘মালাউন’ সম্বোধনের যোগ্য ও পারলেই মারো। কিন্তু একজন সনাতন শিশু কি শেখে ? ওরা মুসলমান, আমাদের প্রতিবেশী, ওদের সাথে বেশি মাখামাখির দরকার নেই আর ঠাকুরঘরে ওদের প্রবেশ নিষেধ। কিন্তু হত্যার হিংসার প্রাথমিক পাঠ একজন মুসলমান শিশু নিয়ে ফেলে। এরপরে বিদ্যালয়ে শিক্ষার সময় সম্প্রীতির কথা বলা হয় অবশ্যই, কিন্তু মক্তব ও মাদ্রাসায় পড়লে তারা সারাদিন একটাই শিক্ষা পায় তা হল ইসলাম বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ধর্ম, বাকিরা কাফের। সেখানে শিক্ষার মাধ্যমে স্বপ্ন দেখানো হয় বেহস্তের। হুরী পরী নিয়ে সে এক মাখোমাখো জীবন। এই পৃথিবীতে তাদের জন্ম জিহাদের কারণে। মক্তব মাদ্রাসা না হয় বাদই দিলাম, বিদ্যালয়ে পড়তে হলে একটি বিষয় হল ‘ধর্ম’। নব্বই শতাংশ ছাত্রছাত্রী পড়ছে ইসলাম ধর্ম, বাকিরা অন্যান্য। এই অন্যান্য ধর্মের পাঠ্যাবস্থা কোন পর্যায়ের তা সহজে অনুমেয়। সবচেয়ে বড় কথা মরাল সায়েন্স বা মানবনীতিবোধ পড়ানো যুক্তি গ্রাহ্য। কিন্তু সরাসরি ধর্ম? সেই গ্রন্থে যা যা বর্ণিত আছে তার সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে কি? ফলে অবচেতন মনে সনাতন বিদ্বেষ বাংলাদেশের ইসলামধর্মীয়দের মধ্যে থেকেই যায়। 

এবারের পুজোর সময় বিভিন্ন জায়গায় যে ক্রমে ক্রমে নারকীয় আক্রমণ ঘটেছে তার সূত্রপাত ছিল নিছকই মামুলি। জনৈক ইকবাল হোসেন পার্শ্ববর্তী মাজার থেকে কোরান শরীফ তুলে দুর্গাপুজোমন্ডপের হনুমানের পায়ের কাছে রেখে হনুমানের গদা কাঁধে ঘুরে বেড়িয়েছে। থানার ওসি একা অটোতে এসে কোরান উদ্ধার করে এবং উপরওয়ালাদের করণীয় কর্তব্য সম্পর্কে উপদেশ চায়। এই ফাঁকে একজন ইসলাম বিপন্ন বলে জিগির তুলে সোশাল মিডিয়াতে লাইভ করে। এই স্পর্শকাতর বিষয়ে দ্রুত পুলিশ পোস্টিং হল প্রাথমিক দায়িত্ব। নাহ, তিনি তা করেন নি। ওখানে উপস্থিত সাধারন জনতা লাইভ করতে বাধা দেয় নি। ফলশ্রুতি মন্ডপ ভাঙচুর, অকালবোধনের প্রতিমা অকালে বিসর্জন। প্রশ্ন ওঠে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন একজনও কি ছিল না কুমিল্লার সেই অঞ্চলে ? বাধা দেওয়ার মত সচেতন ইমান কি কারোর জাগ্রত হয় নি? নাহ, হয় নি, কারণ একটাই শিক্ষা। অনেক বাংলাদেশের নাগরিক সোশাল মিডিয়াতে উদাহরন দিচ্ছেন জ্যোতি বসুর একটি কথার। জ্যোতি বসু বলেছিলেন, সরকার না চাইলে দাঙ্গা হয় না। পরোক্ষে তারা বাংলাদেশ সরকারকে দায়ী করছেন। কিন্তু এ প্রসঙ্গে সবিনয়ে তাদের জানিয়ে রাখি কলকাতার বিজন সেতুতে নৃশংসভাবে আনন্দমার্গী সন্ন্যাসীদের হত্যা করা হয়েছিল এই জ্যোতি বসুর আমলে। মরিচঝাঁপিতে উদ্বাস্তু দখলদারদের মেরে তাদের লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল এই জ্যোতি বসুর আমলে। মৃত ও আহতরা সনাতনধর্মীয়ই ছিলেন। কাজেই বিনাস্বার্থে প্রাণঘাতী আক্রমণ ঘটানো হয় না।   

ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশে এবার যে সনাতনবিরোধী আক্রমন দানা বাঁধল তা ঘটল কার স্বার্থে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল বারকাতের ‘বাংলাদেশে কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি’ শীর্ষক এক গবেষণায় যে তথ্য উঠে এসেছে তা হল ১৯৬৪ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ৫ দশকে মোট ১ কোটি ১৩ লাখ হিন্দু ধর্মাবলম্বি মানুষ দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। অর্থাৎ প্রতি বছর গড়ে ২ লাখ ৩০ হাজার ৬১২ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বি মানুষ নিরুদ্দিষ্ট বা দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। আর প্রতিদিন দেশ ছেড়েছেন গড়ে ৬৩২ জন হিন্দু। গবেষণাটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, এই নিরুদ্দেশ প্রক্রিয়ার প্রবণতা বজায় থাকলে আগামী দু’তিন দশক পরে এদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বি কোনও মানুষ আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। তার গবেষণায় বলা হয়েছে, পাকিস্তানের সামন্ত-সেনা শাসকরা জন্ম সূত্রেই ছিলেন বাংলা ভাষা ও বাঙালি বিরোধী। যে কোনও কায়দায় ব্যাপক হিন্দু জনগোষ্ঠীকে সম্পদচ্যুত, ভূমিচ্যুত, দেশচ্যুত করা গেলে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতিকে বিভক্ত করে শাসন করা সোজা হবে। এ ভাবনা থেকেই পাকিস্তানি সেনা শাসকরা ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে শত্রু সম্পত্তি আইন জারি করে। শত্রু সম্পত্তি আইনে হিন্দু সম্প্রদায়ের মূল মালিকানার ২৬ লাখ একর বেদখল বা ভূমিচ্যুত করা হয়েছে।  হিন্দু সম্প্রত্তি বেদখল করতে স্থানীয় প্রভাবশালী গোষ্ঠী ও ভূমি অফিস সবচেয়ে দায়ী। গবেষণায় বলা হয়েছে, সম্পদ দখল হয়েছে প্রধানত ৫ ভাবে। প্রথমত- স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ভুমি অফিসের সঙ্গে যোগসাজশে উদ্দেশ্য সাধন করেছেন (৭২ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্তের বক্তব্য)। দ্বিতীয়ত-ভূমি অফিসের কর্মকর্তারা নিজেরাই অবৈধ দখল করেছেন (৪৬ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্তের বক্তব্য)। তৃতীয়ত- স্থানীয় প্রভাবশালী মহল বিভিন্ন ধরনের বল প্রয়োগ করেছেন, জোরপূর্বক বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করেছেন, দেশত্যাগে বাধ্য করেছেন (৩২ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্তের বক্তব্য)। চতুর্থ কারণ হলো, প্রকৃত মালিক/ উত্তরাধিকারীদের একজনের মৃত্যু অথবা দেশত্যাগ (৩৫ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্তের বক্তব্য) এবং পঞ্চম কারণ, স্থানীয় প্রভাবশালী মহল জাল দলিল-দস্তাবেজ, কাগজপত্র তৈরি করে ভূসম্পত্তি দখল করেছেন (১৭ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্তের বক্তব্য)। ড. বারকাত তার গবেষণায় উল্লেখ করেছেন, অর্পিত সম্পত্তি নামে শত্রু সম্পত্তি আইন কার্যকর থাকার ফলে হিন্দু হিন্দুধর্মাবলম্বী মানুষ অনিচ্ছায় দেশান্তরিত হতে বাধ্য হয়েছেন। তাহলে যে সত্যটা আজ প্রকট তা হল স্থানীয় অধিবাসীদের লোভী দৃষ্টির কারণে আজও নিষ্পেষিত হচ্ছেন সনাতনধর্মীয়রা। কিন্তু সম্পত্তির লোভ আসল কারণ না কি রাজনৈতিক বিষয় এবারে মুখ্য হয়ে উঠেছে? 

বাংলাদেশের সনাতনধর্মীয়রা চিরকালই বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সমর্থক। সে কারণে তাদের বহু নির্যাতন বিভিন্ন সময়ে সহ্য করতে হয়েছে। গত ১২ বছর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা সেই আওয়ামী লীগের হাতে। স্বাভাবিক নিয়মে এই দলে প্রচুর বেনোজল ঢুকে পড়েছে। মৌলবাদীদের একটা বড় অংশ এই দলে এখন ছড়ি ঘোরাচ্ছে। পক্ষান্তরে একজনও সনাতন নেতা জাতীয় স্তরে উঠে আসেন নি। এই অসাম্য ক্রমেই সনাতন নির্যাতনে সাহসী করে তুলেছে রাজনীতির কারবারীদের। সনাতন নির্যাতনে তাদের দেশত্যাগী করা গেলে লাভ সেই সম্পত্তির। সনাতনদের ভারতমুখী বলে প্রচার কৌশল চিরকালই ত্রাসের মধ্যে রেখেছে সনাতনধর্মীয়দের। আর ভারত বিদ্বেষ বাংলাদেশের মুসলমানদের আরেক শিশুশিক্ষা। ভারত তাদের সর্বক্ষণ শুষে মারছে এই প্রচার বাল্যকাল থেকেই তাদের শেখানো হয়। মুখে যদিও মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান নিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এদেশে এসে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পরে সেই যুদ্ধের সাথে সম্পর্কিত নয় কোন কীর্তির জন্যে কোন ভারতীয়কে বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সম্মানিত করেছে বলে আমার জানা নেই। কিন্তু ভারত ডঃ আনিসুজ্জামানকে ভারতের দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ সম্মাণে সম্মাণিত করেছে। কাজেই সমস্যাটা মানসিকতার। এবারের ঘটনাক্রম নিয়ে বলতে গিয়ে সোশাল মিডিয়াতে ভারতীয়রা এই ঘটনাকে ‘জেনোসাইড’ উল্লেখ করায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেই ফেললেন "সেখানেও (ভারতে) এমন কিছু যেন না করা হয় যার প্রভাব আমাদের দেশে এসে পড়ে, আর আমাদের হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আঘাত আসে।'' নাহ, ভারতের ভারতের ১১২ কোটি হিন্দুদের মধ্যে বড়জোর ৬ কোটি বাঙালি হিন্দুদের কিছু উদ্বেগ প্রকাশিত হয়েছে। আসলে বাঙালি বাদে কোন ভারতীয়র বাংলাদেশ নিয়ে আলাদা কোন উৎসাহ নেই। এমন কি মুসলমানদেরও। যে পবিত্রস্থান বা পাকিস্তানের স্বপ্নে    বাঙালী মুসলমানরা দেশভাগে এককাট্টা থাকল, তারা কি একাত্তরে তাদের স্বধর্মীদের হাতে নিগৃহীত ও নিহত হয় নি? উদ্ধার করল সেই সনাতন ভারত। এরপরেও তারা সনাতনপন্থীদের প্রতি যে ব্যবহার ক্রমাগত করে যাচ্ছে তাকে ‘জেনোসাইড’ বললে কম বলা হয়। তাই সহনশীল হয়ে বাংলাদেশের নিহত বুদ্ধিজীবি জহির রায়হানের ভাষায় বলি, স্টপ জেনোসাইড। কারণ সহ্যেরও একটা সীমা আছে।

No comments